এক ট্যাক্সি চালকের গল্প বলা !
-------------------------
২০০৪ থেকে '০৮ সাল। অন্য কোনো কাজ না পাওয়ায় তখন ট্যাক্সি চালাতাম।
-
একদিনের ঘটনা। আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় ছুটে চলছে আমার ট্যাক্সি। বাহিরে
মৃদু-মন্দ বাতাস আর ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে প্রিয় ক্বারী মিশরী-রাশিদ-
আফাসির তিলাওয়াত। আমার অন্যতম প্রিয় সূরা। সূরা আল-হাদিদ।
রাস্তার
ধারে চোখ পড়লো, ষাটোর্ধ্ব একব্যক্তি। হাত নেড়ে ইশারা করছেন ট্যাক্সি
থামাতে। গন্তব্য কারমুজ। কথা না বাড়িয়ে তাকে নিয়েই আবার ছোটা শুরু করল
আমার হলুদ ঘোড়াটা।
-
গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কোনও এক অজানা কারণে
লোকটি অস্থির হয়ে উঠলেন। ঘনঘন হাঁটু নাড়াচ্ছেন, তো আবার কখনও হাতে হাত
ঘষছেন। কখনও মাথা চুলকাচ্ছেন তো আবার কখনো উদভ্রান্তের মতো জানালার বাইরে
কিছু খুঁজে বেড়াছেন।
আবার হঠাৎ হঠাৎ ঝট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছেন ক্যাসেট প্লেয়ারের দিকে। এমনই সময় সুললিত কন্ঠে মিশরি রাশিদ বলে উঠলেন--
''যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ
হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না
হয়, যাদেরকে এর আগে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। তাদের উপর দীর্ঘ সময়
অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই
পাপাচারী।'' [সূরা আল হাদিদ: ১৬]
-
এই আয়াতটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই কান্নায় ফেটে পড়লেন লোকটি। শিশুর মতো চিৎকার করতে থাকলেন ক্রমাগত।
নিরুপায় হয়ে গাড়ি থামিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিতেই তিনি
কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুরোধ করলেন শেষ আয়াতটি আবার যেন বাজাই। আমি প্লেয়ার
অন করে পুরো তিলাওয়াতটি শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর তিনি কেঁদে যেতে
লাগলেন ক্রমাগত। কান্না থামলে আমাকে শোনালেন এর পেছনের রহস্য:
-
আমার নাম মুসা'দ। হার্টের রোগী। বেশ ক বার অ্যাটাকও হয়েছে। অ্যাটাক আসলেই
প্রতিবারই আমার সন্তানেরা আমার প্রতিবেশী ডাক্তারকে ডেকে আনতো। এক রাতের
ঘটনা। গভীর রাতের দিকে আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হল। ব্যথায় অস্থির
হয়ে আমি চিৎকার করতে থাকলাম।
সন্তানেরা পাগলের মতো ছুটে গেল
প্রতিবেশী ডাক্তারের দরজায়। শীতের সে রাতে তিনি ঘুমের ভান করে দরজা খুললেন
না। আমার সন্তানেরা আমাকে একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেল। 'সরকারী'
নামটার যথার্থ মর্যাদা রাখতেই হয়তো হাসপাতালের লোকজন আমার হার্ট অ্যাটাককে
খুব একটা পাত্তা দিল না। অবহেলায় বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকলাম। ভোর হলে
দেখা যাবে।
-
আমার সন্তানদের পরদিন কাজে যেতে হবে। সেসময় তাদের
পক্ষে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকাটাও অসম্ভব ছিল। তাদের পাংশু মুখের দিকে
তাকিয়ে আমি তাদের মিথ্যে বললাম। বললাম এখন শরীর সুস্থ লাগছে। ব্যথা নেই।
আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।
বাড়ি ফিরে আমার ব্যথাটা এতো বেড়ে গেল যে
আর সইতে পারছিলাম না। এদিকে ঘরের কাউকে ব্যাপারটা বুঝতে দিতেও চাচ্ছিলাম
না। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। কোন রকমে মাহামাধ্যায়া(
আলেকজান্দ্রিয়ার একটি পুরাতন লেক) এর কাছে এসে সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম।
মনে হতে লাগলো সময়টা যেন থমকে গিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যুগের পর যুগ
যেন কেটে যাচ্ছে। আমি সিজদায় পড়ে আছি। আমার সমস্ত আবেগ আর অনুভূতির
সবটুকু দিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম--
''হে
আল্লাহ! তুমি হয়তো আমাকে এই শাস্তি দিচ্ছো কারণ আমি তোমার ইবাদত করি না।
এবারের মতো আমায় ক্ষমা করো, আর একটিমাত্র সুযোগ আমাকে দাও; আর কক্ষনো,
কোনোদিন একটি রাক'আত সালাতও আমার ছুটবে না।''
-
দুয়াতে কাজ হল না। ব্যথা আরও বেড়ে গেল। আমি হাহাকার করে উঠলাম--
থামাও হে আল্লাহ! আমার জন্য একটুও করুণা হয় না তোমার?"
কিছুক্ষণ পরই আমার ব্যথা কমে এলো। কখন যেন নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো ভোরের নরম আলোয়। শরীর বেশ ফুরফুরে, চাঙা। চারিদিকে
গভীর শান্তি শান্তি একটা ভাব। দীর্ঘ ঝড়ের পর যেন সবকিছু শান্ত, নীরব। একটা
পবিত্র স্নিগ্ধতা সর্বত্র। আহা!
-
ঘটনার পর দীর্ঘদিন কেটে গেছে।
আমার বুকে ব্যথা তো দূরের কথা আর কক্ষনো হার্টের সমস্যাও আর হয়নি। কিন্তু
আমি আর এক রাক’আত সালাতও আর কখনো আদায় করিনি। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম
স-অ-ব। যেন এমন কোনো কিছুই কখনো ই ঘটেনি।
আজকের এই তিলাওয়াতটি যখন
শুনছিলাম, আমার মনে হচ্ছিলো স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা আমার সাথে কথা
বলছেন। তাঁর ইবাদাত না করায় যেন আমাকে কড়া ভাষায় শাসন করছেন।
-
ওয়াল্লাহি! আমি এই ভয়ে কাঁদছি না যে আল্লাহ আমাকে আবারও অসুস্থ করে দিতে
পারেন। আমি কাঁদছি লজ্জায়, নিজের প্রতারণার লজ্জায়। পরম করুণাময় আমার
কথা রেখেছেন, আমার দুয়া শুনে আরও একটা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু আমি? আমি
করেছি শুধুই প্রতারণা!
...................................collected
No comments:
Post a Comment